‘নাম তালু’ বিপর্যয়ঃ গুহার গুপ্ত বিপদ এবং এক তরুণীর ভাগ্য

১৬০ মিলিয়ন বছরের পুরনো দক্ষিণ থাইল্যান্ডের ’খাও সোক’ জাতীয় উদ্যানের ‘নাম তালু’ গুহায় এক দম্পতির আটকে পড়ার ভয়াল ঘটনা আজো অনেকের মনে গুহায় বেড়াতে গিয়ে অজানা সব বিপদে পড়ার আশঙ্কা জাগিয়ে তোলে। আজকের ব্লগটি এই ঘটনার উপরেই।

২০০৭ সালের অক্টোবরে হেলেনা ক্যারল নামে একজন ব্রিটিশ মহিলা, যিনি শিল্প-কারখানার প্রশিক্ষণ প্রদানকারী সংস্থা ‘এমপাওয়ার’-এর জন্য কাজ করতেন, এবং তার বাগদত্তা জন কুলেন, সামান্য কিছু অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন এবং এটি দিয়ে কী করবেন তা নিয়ে তারা বেশ দোটানায় ছিলেন। তারা জানতেন যে, তাদেরকে এই জমানো টাকা একপাশে রাখা উচিত এবং একটি নতুন বাড়ির জন্য ডাউন পেমেন্টের দিকে রাখা উচিত। কিন্তু তারা সত্যিই ছুটিতে যেতে চেয়েছিলেন কারণ সাম্প্রতিক সময়ে, তাদের উভয়ের জন্য জীবন বেশ চাপের ছিল এবং শেষ পর্যন্ত, তারা একটি আশ্চর্যজনক ছুটিতে সমস্ত জমানো টাকা উড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

হেলেনা ক্যারল এবং জন কুলেন

সেই মাসের পরে, তারা থাইল্যান্ডে বেড়াতে চলে গেলেন। তাদের সপ্তাহ জুড়ে, তারা বেশিরভাগ সময়টাই রিসোর্টে তাদের সময় পুলে বসে কাটালেন এবং নানা জাতের নতুন ধরনের খাবার খাওয়ায় সময় ব্যয় করলেন। এবং তারা সত্যিই চমৎকার সময় কাটাচ্ছিলেন।

থাইল্যান্ডে তাদের ঘুরে বেড়ানোর শেষ দিনে, তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তাদের আরও কিছুটা দুঃসাহসিক কিছু করতে হবে। তাই, তারা দক্ষিণ থাইল্যান্ডের ‘খাও সোক জাতীয় উদ্যানের’ অভ্যন্তরে ‘নাম তালু’ গুহাটি দেখে আসার করার সিদ্ধান্ত নেন। এই গুহাটি একটি ১৬০-মিলিয়ন বছরের পুরানো চিরসবুজ অরণ্যের ভেতরে অবস্থিত যা তাদের রিসর্টের কাছাকাছি ছিল না। আসলে, এটি সত্যিই কোন বিশাল পর্যটন গন্তব্য ছিল না কারণ সেখানে যাওয়া ছিলো অনেক কষ্টকর একটি যাত্রা। এজন্য পর্যটকরা এই গুহা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু তারা এই পার্ক সম্পর্কে বেশ খানিকটা পড়াশুনা করেছিলেন এবং বিশেষ করে এই গুহাটিতে তারা যেতে চেয়েছিল কারণ তাদের একটি শ্বাসরুদ্ধকর অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রয়োজন ছিল এবং তাই তারা এই বিশেষ ভ্রমণটির লোভ সংবরণ করতে পারেননি।

একটি গাইডেড ট্যুরের জন্য সাইন আপ করার পরে, তারা পিয়ারের দিকে রওনা হলেন, যেখানে তারা একটি নৌকায় চড়ে এই পার্কের প্রবেশদ্বারে ৯০ মিনিট গাড়ি চালিয়ে এসে পৌঁছান। যখন তারা নামলেন, তারা তাদের দুই গাইডের সাথে দেখা করলেন এবং তারপর এই গূহামুখে নেমে গেলেন, যেখানে অন্য পাঁচজন পর্যটকের সাথে তাদের দেখা হয়, যারা তাদের সাথে এই সফরে যাচ্ছিলেন। সেই পাঁচজন ব্যক্তি ছিলেন দুই সুইস বাবা-মা এবং তাদের দুই কিশোরী কন্যা, সাথে দশ বছরের এক জার্মান ছেলে, যে একাই সেখানে ছিল। সবাই কুশল বিনিময় এবং নিজেদের পরিচয় দেওয়ার পরে, তারা পার্কের মধ্য দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন।

‘নাম তালু’ গুহাটির মোহনীয় দিকটি ছিলো যে, সেখানে একটি নদী ছিল যা এর মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। এখানে, এই গুহার মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মাঝে মধ্যেই আপনাকে একটি দড়ি ধরে জলের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যেখানে জল আপনার কোমর পর্যন্ত বা এমনকি কখনও কখনও আপনার ঘাড় পর্যন্ত উঠতে পারে। এটা বেশ বিপজ্জনক শোনাচ্ছে! তাই না? কিন্তু এটি এই পর্যটক দলের কাছে নিরাপদ এবং নিয়ন্ত্রিত মনে হয়েছিল। বিদেশী পর্যটকদের জন্য গুহার মধ্য দিয়ে যাওয়া এক ধরণের রোমাঞ্ছকর অভিজ্ঞতা ছিল।

তারা যখন ‘নাম তালু’ গুহার প্রবেশপথে পৌঁছতে যাচ্ছিল, তখন কিছু পার্ক রেঞ্জার তাদের পাশের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। তারা এই সফরে নেতৃত্বদানকারী দুই স্থানীয় গাইডের সাথে কিছু কথা বিনিময় করলেন। রেঞ্জাররা তাদের বলেছিল যে ‘নাম তালু’ গুহায় যাওয়া একটি খারাপ ধারণা; কারণ এটি বর্ষাকাল। এই সময়ে সেখানে কারও থাকার কথা নয়। এবং যদি তারা গুহার ভিতরে থাকার সময় বৃষ্টি শুরু হয়, তবে তারা বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে পাবে না এবং এটি গুহাকে প্লাবিত করবে এবং তারপর তারা এই গুহার ভেতরে আটকে যেতে পারেন।

যাইহোক, সতর্কতা সত্ত্বেও পর্যটক দলটি তাদের যাত্রা অব্যাহত রাখেন। কারণ সেদিন গুহার আশেপাশে কোথাও বৃষ্টি হয়নি। আবহাওয়ার পূর্বাভাসেও কোন বৃষ্টি ছিল না এবং এই সফরের নেতৃত্বদানকারী দুই স্থানীয় গাইড সত্যিই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তারা বিপদে পড়বেন না।

দলটি দুপুর ১টার একটু পরে গুহায় প্রবেশ করে এবং তারা জলের ছোট ছোট গর্তের মধ্য দিয়ে হাঁটছিলেন যা ধীরে ধীরে গভীরে যাচ্ছিলো। খুব শীঘ্রই তারা দড়ি ধরে গুহার গভীর অংশ দিয়ে হাঁটা শুরু করেন। জল তাদের কোমর পর্যন্ত ছিলো এবং সব দিক থেকেই এটি খুব উত্তেজনাপূর্ণ ছিল! ভ্রমণের স্থায়িত্ব হঅয়ার কথা ছিলো মাত্র এক ঘন্টা, যেখানে ৩০ মিনিটের মধ্যে, দলটি টার্নঅ্যারাউন্ড পয়েন্টে যাবে এবং সেখান থেকে ফিরে বাকি ৩০ মিনিটে ফিরে আসবে।

টার্নঅ্যারাউন্ড পয়েন্টের ঠিক কাছেই ২০ থেকে ২৫ মিনিট এগুনোর পর, হেলেনা এবং জন, যারা ট্যুর গ্রুপের সামনে ছিল তারা কোন একটা শব্দ শুনতে পান। এটা একটা হুড়োহুড়ি বা তেমন কিছু একটার মত শোনাচ্ছিল, যেন গুহার প্রবেশদ্বার থেকে গর্জনের শব্দ আসছে। তারা ফিরে তাকালেন এবং দেখতে পেলেন জলের বিশাল এবং প্রবল ঢেউ গুহায় ঢুকে যাচ্ছে।

সহজাতভাবে, জন এবং হেলেনা খুব দ্রুত দেয়ালের উপরে উঠতে শুরু করে দেন এবং সৌভাগ্যবশত তারা যেখানে ছিলেন, সেখানে গুহার গায়ে একটি ধার ছিল এবং তারা এই প্রান্তের উপরে উঠতে সক্ষম হন। পরবর্তীকালে, হেলেনার ভাষ্যমতে, সেখানে উঠার সাথে সাথেই তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে যান কি হচ্ছে তা দেখার জন্য। তিনি ঘুরে দাঁড়ান এবং দেখতে পান জলের এই ঢেউ তাদের পাশ দিয়ে বিস্ফোরিত হয় এবং তাদের চোখের সামনেই, দুই ট্যুর গাইড এবং দশ বছর বয়সী জার্মান ছেলেকে জল টেনে নিয়ে যায়। এবং তারপর কয়েক সেকেন্ড পরে, দুই সুইস বাবা-মা এবং তাদের কিশোরী কন্যারাও কোণের দিকে জলে ভেসে যায়।

এই দম্পতি এখন এই প্রান্তে আটকা পড়ে গেলেন। তারা যা তাদের সামনে ঘতে যেতে দেখছেন তা নিয়ে বিচলিত হওয়ার সময় এখন আর তাদের নেই। এর কারণ, জল শুধু তাদের পাশ দিয়ে বইছিলো না, এটা উপরের দিকে বাড়ছিলো। তারা বুঝতে পারেন কিছুক্ষণের মধ্যেই এই সীমিত পরিমাণ সম্পূর্ণরূপে জলে নিমজ্জিত হবে। এবং তাই, তারা এই গুহার দেয়ালের একটি সামান্য উঁচু প্রান্তে ওঠার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন, যেটি তখনও মাত্র কয়েক ফুট দূরে ছিল এই প্রবল স্রোত থেকে।

যখন তারা এই প্রান্তে কোনরকমে এসে পৌঁছেন, জন অবশেষে হেলেনাকে বলে, “দেখো, আমরা যদি এখানে থাকি তবে আমরা মারা যাব, আমরা ডুবে যাব। আমাকে সম্ভবত এই প্রাথমিক জলের স্রোত পেরিয়ে যাওয়ার জন্য একটি উপায় খুঁজে বের করতে হবে, এবং হয়তো গুহার পাশের দিকে আমি প্রবেশদ্বার পর্যন্ত ফিরে যেতে পারি। এবং আশা করছি, আমাদেরকে সাহায্য করার জ্ন্য কাউকে পাবো।” 

শুরুতে, হেলেনা বলেছিলেন, “এটা করো না! এই জায়গা ছেড়ে যেও না! আমরা এখানে নিরাপদ।”

কিন্তু অবশেষে, জন তাকে বললেন, “আমাকে যেতে হবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই আমাকে যেতে হবে। আমাকে একটা উপায় বের করতে দাও।”

হেলেনা বলল, “ঠিক আছে!”

এবং তারপর জন জলে ঝাঁপ দিলেন, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে, প্রবল স্রোত তাকে নীচে টেনে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

পরবর্তী ২০ ঘন্টা, হেলেনাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে এই প্রান্তে বসে থাকতে হয়েছিল, যতক্ষণ না জল শেষ পর্যন্ত কিছুটা কমতে শুরু করে এবং উদ্ধারকারীরা তাকে খুঁজে পায়।

উদ্ধারের পর হ্যালেন ক্যারল

হেলেনা এবং ট্যুর গ্রুপের বাকি সদস্যরা গুহার ভিতরে যাওয়ার পর যা ঘটেছিল, তা ছিলো এরকমঃ

হেলেনা এবং গ্রুপের বাকি সদস্যেরা যখন গুহার ভেতরে ঢুকে গেলেন, তারা এমন এক জায়গায় গিয়ে পৌঁছান, যেখান থেকে বাইরে কি ঘটছে তা তারা শুনতে পাননি। ঠিক সেই মুহুর্তে, গুহার ঠিক বাইরে একটি বিশাল উন্মত্ত ঝড় বয়ে যায় এবং এই আকস্মিক বন্যায় গুহার পাশেই একটি হ্রদের পানি উছলে পড়ে, এবং সরাসরি গুহার মধ্যে পানি ডাম্পিং শুরু করে। এটি মূলত ছিলো একটি বিশাল বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার মতো, এবং হ্রদের সমস্ত জল একবারে গুহার দিকে ঢেলে দেয়। আর এ কারণে পানির বেগও ছিল তীব্র।

উদ্ধারের পর অ্যাম্বুল্যান্সে হ্যালেন ক্যারল

শেষ পর্যন্ত যখন হেলেনাকে গুহা থেকে বের করে আনা হয়, তখন তিনি জানতেন না যে তার বাগদত্তা বা অন্যান্য পর্যটকদের সাথে কী ঘটেছে, যারা এই দলের অংশ ছিল। কিন্তু যখনই তিনি বাইরে পা রাখলেন, তিনি দেখতে পেলেন যে আটটি কফিন ঠিক বাইরে সারিবদ্ধভাবে রাখা আছে। এবং তিনি জানতে পারেন  যে তিনিই ৯ জনের মধ্যে বেঁচে থাকা একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। জনসহ বাকি আটজনের কেউই বেঁচে নেই।

এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডি সত্ত্বেও, লোকেরা এখনও বর্ষাকালেও ‘নাম তালু’ গুহায় রোমাঞ্চের খুঁজে যান।

যারা এ ধরণের গুহায় অ্যাডভেঞ্চারে আগ্রহী,  তাঁদের প্রতি অনুরোধ, এই সত্য ঘটনা থেকে সাবধান হবেন এবং কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বার বার ভেবে নেবেন, বিশেষত বর্ষার দিনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *